Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

Title
ইচ্ছা শক্তিই বড়
Attachments

তরুণীটি তখন সবে স্নাতক পাস করেছেন। বড় আশা করে কাগজপত্র নিয়ে গেলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে। একটি বিদ্যালয় গড়ার কথা জানালেন। এই বয়সে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা শুনে চোখ কপালে উঠল ওই কর্মকর্তার। বললেন, ‘মেয়ে মানুষ হয়ে কোন সাহসে এ কাজ করতে এসেছেন? চলে যান।’ সেদিন ওই কর্মকর্তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে কেঁদেছিলেন খুব। পরক্ষণেই পণ করেছিলেন, এমন এক বিদ্যালয় গড়বেন, যা হবে সবার জন্যঅনুকরণীয়।

স্বপ্নের সেই বিদ্যালয় তিনি গড়েছেন। প্রধান শিক্ষকও হয়েছেন। সে দেড় দশক আগের কথা। এরই মধ্যে বিদ্যালয়টি অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে আর দশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে। অথচ এমন বিদ্যাপীঠেই নেই কোনো শ্রেণীকক্ষ। অবকাঠামোর অভাবে শুরু থেকেই পাঠদান চলছে গাছতলায়। সব শিক্ষক এখনো পান না বেতন। তবু সাত বছর ধরে শতভাগ শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করে চলেছে এ বিদ্যাপীঠ থেকে।

প্রকৃতির বুকে গড়া এই পাঠশালার কারিগর শিউলি খাতুন। এটি রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় অবস্থিত। নাম এস আর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। শিউলি একটি ব্রত নিয়েছেন, তাঁর বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী যেন এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য না হয়। তাঁর ভাষায়, রোদ-বৃষ্টির কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য ঘরের প্রয়োজন আছে। তবে প্রকৃত শিক্ষা শুধু সুরম্য ভবনের ভেতরেই হয় না। তার প্রমাণ দিয়েছে তাঁর গাছতলার শিক্ষার্থীরা।


শত বাধা ডিঙিয়ে:  শিউলির উদ্যোগে গ্রামবাসী হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেদিন। তা ১৯৯৮ সালের কথা। কেউ জমি, কেউ বাঁশ, কেউবা টিন দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। তোলা হয়েছিল টিন, বাঁশ ও চাটাইয়ের লম্বা, ছাপরা একটি ঘর। সে ঘরেই সব শ্রেণীর ক্লাস চলত।

উপজেলার সিংড়া ও রামকৃষ্ণপুর—এই দুই গ্রামের মানুষ মিলে সিংড়া গ্রামে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। দুই গ্রামের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়—এস আর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত। নবম-দশম শ্রেণীরও অনুমোদন আছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ২৫০ জন, শিক্ষক ১৩ আর কর্মচারী চারজন। এর মধ্যে ছয় শিক্ষক ও একজন কর্মচারী বেতন পান না। ছয় শিক্ষকের সবাই নবম-দশম শ্রেণীর ক্লাস নেন। শুরু থেকেই আছেন তাঁরা।

শিউলি বলেন, শুরুর দিকে অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। বিদ্যালয় গড়তে গিয়ে নিজের প্রতি খেয়াল ছিল না কোনো দিনই। সংসারে তাঁর ছেলেমেয়ে নেই। স্বামী ছিলেন শিক্ষক। এখন অবসরে। শিউলি খাতুনের ভাষ্য, ‘স্কুলই আমার সব।’


ভবন নেই, শ্রেণীকক্ষ নেই—এ নিয়ে যাতে কেউ হীনম্মন্যতায় না ভোগে, এ জন্য তিনি শিক্ষার্থীদের সব সময় উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়ে চলেন। তাঁর মতে, শিক্ষকের আন্তরিকতাই শিক্ষার্থীর জন্য বেশি প্রয়োজন। তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করছেন। ২০৩৭ সালে বিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার ইচ্ছা শিউলির। সে পর্যন্ত প্রতিবছর এই বিদ্যালয় থেকে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করবে—এই তাঁর আশা।
অভিভাবকদের উৎসাহ জোগাতে শিউলি নিয়মিত মা সমাবেশ ও অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করেন। সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকের ফোন নম্বর আছে তাঁর কাছে। কোনো শিক্ষার্থী এক দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলেই তিনি ফোন দেন।
 

বিদ্যালয়ে একদিন:  পুঠিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে সিংড়া গ্রামে পড়েছে বিদ্যালয়টি। গত ১৬ এপ্রিল সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর ক্লাস চলছে গাছের নিচে। প্রধান শিক্ষকের আধা পাকা কার্যালয়ের বারান্দায় নবম শ্রেণীর, আর একটি ছোট্ট চালাঘরের নিচে হচ্ছে দশম শ্রেণীর ক্লাস। দুটি করে খুঁটি পুঁতে ব্ল্যাকবোর্ডগুলো বাঁধা। খুঁটির সঙ্গে চাটাই খাড়া করে দুই ক্লাসের মধ্যে বিভাজন দেয়াল দেওয়া হয়েছে। ভাঙা ঘরের চালা গাছের সঙ্গে খাড়া করে আরেকটি শ্রেণীকক্ষের আঙিনা ঘিরে নেওয়া হয়েছে। গাছের ছায়ায় বসে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে ক্লাস করছে। কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, নেই হইচই।


প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সাদামাটা গোছের একটি কক্ষ। কিন্তু ক্রেস্ট আর সম্মাননাপত্রে ঠাসা। প্রতিবছর স্থানীয় সাংসদ ও শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে শতভাগ পাসের সাফল্য হিসেবে সংবর্ধনা পেয়ে আসছে বিদ্যালয়টি।
স্কুলের আঙিনার এক পাশে তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি ইটের ঘর তৈরির কাজ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। জানতে চাইলে শিক্ষকেরা বলেন, প্রধান শিক্ষক তাঁদের ক্রেস্ট আর সম্মাননা নিয়ে পুঠিয়া উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। তারা সব দেখেশুনে অল্প কিছু টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। তাই দিয়ে এই ঘরের দেয়ালটুকু করা সম্ভব হয়েছে। আর কোনো বরাদ্দ নেই।
অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জুলেখা খাতুন বলে, ‘গাছের নিচে বসে ক্লাস করছি, তাতেও আমাদের কোনো দুঃখ নেই। সরকার যেন আমাদের শিক্ষকদের বেতনটা দেয়। আমরা বিদ্যালয়ে একটা ভবন চাই। তার আগে চাই আমাদের শিক্ষকদের বেতন।’
দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী কেয়া খাতুন জানায়, এত দিন ভালোই গেল। সামনে বর্ষা আসছে। তাদের আবার ভিজতে হবে। বর্ষায় তাদের বই-খাতা বাঁচানোর টেনশনে থাকতে হয়। বৃষ্টি হলে ক্লাস বন্ধ থাকে।

বেতন না পাওয়া একজন শিক্ষক প্রভাষ চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, একদিন বেতন হবে—এই আশাতেই বুক বেঁধে তাঁরা বিদ্যালয়ের ভালো ফলাফলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। প্রভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, তাঁরা এই কাজটাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। এ থেকে বের হওয়ার উপায় নেই।